'অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?' | © আবুল হাসনাত বাঁধন

‘অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’

অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’ | আবুল হাসনাত বাঁধন

অনিন্দ্য,
আজ কত বছর পর তোমাকে দেখলাম!
চামড়ার ভাজে ভাজে বয়স বেড়েছে আমাদের।
অথচ শুক্লপক্ষের চাঁদটা সেই আগের মতোই আছে।
সেই তেরো বছর বয়সে, ফ্রক ছেড়ে গায়ে কামিজ জড়ানোর দিনগুলোতে এই চাঁদ—
একবার আমার বয়স আটকে দিয়েছিল।
জানালার ফাঁক গলা জোছনার সমুদ্রে সেদিন তোমাকে আবিষ্কার করেছিলাম আমার হৃৎপিণ্ডের ভেতর।
তুমি ঠিক যেন নরম শামুক আর আমি শক্ত কঠিন খোলস।

চঞ্চল কিশোরী বুকের ভেতর একটা তুমি তিরতির করে বাড়ছিলে।
প্রতিটা নিশ্বাস আর রক্তস্রোতে, তোমাকে আমি অনুভব করেছিলাম স্নায়ুর মতো।
অথচ তুমি কিছুই জানতে না!
ঠিক যেমন আজতক জানতেও পারোনি।
আমার একক অনুভূতির চাদর শুধু আমিই জড়িয়েছি শরীরের মেঝেতে।
এই দেহঘরে আর অন্য আলো প্রবেশ করতে পারেনি!

অনিন্দ্য,
মনে আছে, সেই এক কোনার ক্লাসঘর, কয়েক সারি পুরোনো বেঞ্চি, তুমি আমি খুব কাছাকাছি বসা!
অথচ তোমার আমার কয়েক আলোকবর্ষ দূরত্ব।
সমাজ আর ধর্মের শিকল দুপায়ে বাঁধা ছিল আমার।
তাই তো মুসলমান হয়ে, হিন্দু ছেলেটার দিকে হাত বাড়াবার সাহস হয়নি আর।

বুকের ভেতর তেড়ে ফুঁড়ে চলে যাচ্ছিল যে শব্দঝড়টা—
তার ঠাঁই হয়েছিল জলপাই রঙা ডায়রির পাতায়।
এই সেই ডায়রি, যেটা কেউ কখনো উলটোয়নি!
এত বছর পর আবার অব্যক্ত পঙক্তি লিখতে বসেছি তোমাকে।
জানি তোমার বাড়ির ডাকবাক্সে আদতে কোনো চিঠি পৌঁছোবে না!
এতটা বছর কোনো ডাকপিয়নের সময় হয়নি যেমন!
ক্লাসঘর শূন্য পড়ে আছে, পাশের গাছটার ঝাঁকড়া কদম ফুল শুকিয়ে পঁচে গেছে,
ক্যান্টিন আর কল-তলা যেন কোনো প্রাচীন শশ্মান!
অথচ চোখ বুজলেই একটা স্মৃতি-ট্রেন আমাকে নিয়ে যায় অতীতপুরী;
ঠান্ডা একটা অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গিয়ে, সিলিংয়ে উঠে পড়ে!

অনিন্দ্য,
আজ, এতগুলো বছর পরে আমাদের দেখা না হলেও পারতো!
আমি তো ভালোই ছিলাম এতদিন, স্বামী-সন্তান নিয়ে।
কোনো এক অবেলায় রান্না চড়াতে চড়াতে দূর দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে;
অথবা চান্নিপহর রাতে আমার চোখের ভেতর ফোটা মেঘফুল নিয়ে;
কিংবা সেই জলপাই রঙা ডায়রি নিয়ে;
আমি তো ভালোই ছিলাম!
ঠিক যতটা ভালো আছে নিঃসঙ্গ ঈশ্বর!

দিন সাতেক আগে বিয়ের কার্ডটা আমার বাড়িতে না আসলেও তো পারতো!
কেন আসলো ওটা?
কেন আমি বিয়ে বাড়িতে গিয়ে রঙিন সাজসজ্জা আর অজস্র ফুলের ভিড়ে তোমার নামটা দেখলাম?
নিজের সবচে’ প্রিয় বন্ধুর পাশে তোমার নামটা যে কতটা বেমানান আমার চোখে—
কেউ কি জানবে সে কথা?
‘ওয়েডিং অব অনিন্দ্য রায় অ্যান্ড অর্পিতা দে’ —
লাইনটা যতবারই চোখে পড়ছিল,
সুঁচের মতো সুক্ষ্ম একটা আদিম কষ্ট আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাচ্ছিল।
অথচ আমার শরীর সেলাই করার মতো কোনো দরজি নেই।

অনিন্দ্য,
একটু পর ভোরের আলো ফুটবে!
আকাশে পোয়াতি মেঘের আনা-গোনা হবে।
পাখির কণ্ঠে শোনা যাবে আজানের মতো বোহেমিয়ান মর্সিয়া।
তুমি হয়তো ঘুমিয়ে আছো অর্পির অন্তর্বাসহীন বুকে!
অথচ, আমি একটুও চোখ বুজতে পারছি না;
অক্টোপাসের মতো কষ্টের দলা আমার সমস্ত শরীর আঁকড়ে ধরছে!
আমি কি এখন ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরব?
জায়নামাজে আঁকা মিনার ছুঁতে ছুঁতে জল হয়ে যাব?

‘অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’

© আবুল হাসনাত বাঁধন

(০৪/০২/২০২০)

রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর।

 

[কিওয়ার্ডস: অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব? , অনিন্দ্য রায় , আবুল হাসনাত বাঁধন , কবিতা , বিয়োগাত্মক কবিতা]

#আরও পড়ুন » সেরা ৪টি ভিডিয়ো ইডিটিং অ্যাপ্লিকেশন!

Share With Love:

2 thoughts on “‘অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’”

  1. Pingback: বিবর্তন | সাহিত্য, অন্যান্য, গল্প, মুক্তকথা | Badhon

  2. Pingback: এক ভাষা সেনাপতির কথা! | সাহিত্য | Badhon

মন্তব্য করুন: