গঙ্গাফড়িং ও প্যাঁচার গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন
বড়ো’দি আমার তিন বছরের বড়ো ছিল।
আমি ওকে ‘গঙ্গাফড়িং’ ডাকতাম ভালোবেসে।
ওর কালো রঙের দুটো পাখনা ছিল;
শুক্লা দ্বাদশীর রাতের মতন ম্লান অন্ধকার মাখানো।
দি’ আমাকে ডাকত ‘প্যাঁচা’;
আমার নাকি প্যাঁচার মতন বোঁচা নাক!
ওর ডাক অবশ্য আমার কাছে আজানের সুরের মতো পবিত্র ছিল।
ঘাসফুল সদৃশ শাশ্বত ভালোবাসা মাখানো ছিল সেই ডাকে।
ও যখন হাঁটত, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত নুরের ঝিলিক।
দি’র কণ্ঠস্বর, কোরান আর গীতার মতন সশব্দে ঝংকার তুলত আমার হৃৎপিণ্ডে।
ওর পদধ্বনি ছিল মন্দিরের শাঁখ-ঘণ্টার মতো।
আমি ওকে আবিষ্কার করেছিলাম, আরবি হরফের নোকতা রূপে।
আমাদের মা ছিল না; এমনকি সৎ মা’ও না!
‘গঙ্গাফড়িং’ই ছিল আমার মমতাময়ী জননীর আসনে প্রোথিত।
ওর আঁচলে আমি স্নেহার্ঘ্য খুঁজে নিতাম।
দি’র গায়ে সোনালি ধানের ঘ্রাণ ছিল, আমি ওর অন্ন-নিশ্বাসে বেঁচে থাকতাম।
দি’র নাকের ডগায় জমা ঘাম,
মাঝে মাঝে অসাবধানতায় জ্বলজ্বলে শিশিরবিন্দুর মতন ঝরে পড়ত আমাদের সালুনের বাটিতে।
তখন সালুনগুলো হয়ে উঠত স্বর্গীয় অমৃত খাবার।
আমরা গোগ্রাসে গিলতাম ওগুলো।
#আরও পড়ুন » ‘অনিন্দ্য রায় : আমি কি জল হয়ে যাব?’
দি’ তার খোঁপায় বেঁধে রেখেছিল আমাদের উদ্দাম শৈশব।
কত ভয়ংকর নৈঃশব্দ্যিক রাত পেরিয়ে গেল,
পেরিয়ে গেল ঠা ঠা রোদ্দুর কিংবা ঝুম বৃষ্টির দিন;
কত বজ্রের আঘাতের কেঁপে কেঁপে উঠল পৃথিবীর বুক।
অথচ, ‘গঙ্গাফড়িং’ এর বুকে আশ্রিত আমি কিছুই টের পাইনি।
তারপর একদিন,
আমাদের সবুজ স্বপ্ন বিছানো উঠোনে হানা দিলো সাদা ডানার খ্যাও-রাক্ষসের দল।
ওরা শুধু চিৎকার করে আকাশে ক্রন্দন তোলে-
‘আছে আছে, খ্যাও খ্যাও, আছে আছে, খ্যাও খ্যাও!’
ওদের থাবার আঘাতে, গঙ্গাফড়িং এর একটা ডানা খসে পড়ে গেল।
আমি শুধু চেয়ে দ্যাখলাম, আমার আহত সহোদরার বিক্ষত ডানা;
জান্নাতুল ফেরদৌসে প্রবাহিত জলের মতন পবিত্র ওর রক্ত,
রাঙিয়ে দিচ্ছিল তামাটে মাটির পেলব জমিন।
রক্তের আঁশটে গন্ধে আমার মাথা গুলিয়ে এলো।
হঠাৎ এক সবুজ ডানার টিঁয়ে এলো, আমাদের রক্ষাকর্তা রূপে।
দি’কে বাঁচিয়ে নিলো সে খ্যাও-রাক্ষসের হাত থেকে।
তারপর কেটে গেল বহুদিন-বহুরাত, ক্ষতের দাগ শুকিয়ে এলো;
মাটির উঠোনে, দি’র রক্তের জায়গাটায় জেগে উঠল একঝাঁক কৃষ্ণচূড়া!
তারপর একদিন,
আমাকে একা ফেলে, আমার ‘গঙ্গাফড়িং’ সেই টিঁয়েটার পিঠে চড়ে উড়ে গেল দূরে; বহু দূরে;
যে দূরত্ব পেরিয়ে গ্যাছে দিগন্তরেখার ব্যপ্তিকে।
মাঝে মাঝে কথা হতো দি’র সাথে;
কিন্তু একদিন প্যাঁচী এসে বাঁধিয়ে দিলো ভুল সুর।
আমার ‘গঙ্গাফড়িং’ আর বুঝল না তার প্যাঁচাকে!
দি’র সাথে এখন আমার যোজন যোজন দূরত্ব,
বিদ্বেষ পাখা গজিয়েছে প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো বিস্তৃত করে।
তবুও কথা হয় ‘গঙ্গাফড়িং’, থ্যালামাসের গভীরতম প্রকোষ্ঠ থেকে;
‘ভালো আছিস তুই, মায়ের মতো?
মা আছে আকাশে তারা হয়ে; আর তুই ভিনদেশে আমায় ভুলে।
মেঠো বাড়ির জানালাটায় চারটে শিক;
ওপাশে লক্ষ-কোটি নক্ষত্রে সাজানো রাত্তির।
আর এপাশে আছি আমি,
বিছানার চাদর আর তোর সিথানের বালিশে মাখা ঘ্রাণ নিয়ে।
পুরোনো কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে ভেবে নিই তোর স্পর্শ;
মিছে সান্ত্বনা!
#আরও পড়ুন » বিবর্তন
কৃষ্ণচূড়ায় ছেঁয়ে গ্যাছে সেই উঠোনটা;
কত গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত পেরিয়েছে, শেষ হয়েছে রুক্ষ শীতের দিন!
কতটা সময় মহাকালের ভোগে চলে গেল!
এই ফাগুনেও এলি না তুই!
আমায় বুকে চেপে ধরে বললি না ‘কেমন আছিস প্যাঁচা?’
তোর প্যাঁচার খোঁজ কে রাখে আর?
ভাত-ঘুমের হিসেবগুলো?
প্রজাপতির নরম রং মাখায় কে?
কে শোনায় এখন ঘুম পাড়ানি গান?
জানিস?
তোর প্যাঁচাটা স্বপ্নিল আকাশে ভাসতে ভুলে গ্যাছে রে ‘গঙ্গাফড়িং’!
অনুভূতি গুলো ফিকে হয়ে এসেছে স্নায়ুর ভেতর।
কার চোখে জীবনের ছন্দ খুঁজবে সে?’
‘গঙ্গাফড়িং ও প্যাঁচার গল্প’ | © আবুল হাসনাত বাঁধন
রচনাকাল: (১৬/০৯/২০১৭)
স্থান: পটিয়া, চট্টগ্রাম।
উৎসর্গ: গঙ্গাফড়িং
*****
এই ধরনের আরও জীবনধর্মী কবিতা পড়তে আমাদের সাইটে যুক্ত থাকুন। কবিতাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।
[কিওয়ার্ডস: গঙ্গাফড়িং ও প্যাঁচার গল্প , গঙ্গাফড়িং , প্যাঁচার গল্প , আবুল হাসনাত বাঁধন , কবিতা , বিয়োগাত্মক কবিতা]
মর্মস্পর্শী কবিতা…।