পৃথিবীটা ভালোবাসার হোক, ভালোবাসাময় হোক! | আবুল হাসনাত বাঁধন
আমি বছরখানেক আগে পর্যন্তও দুই বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করিনি! বিস্তারিত জানতামও না! কলোনি’জমের কারণে, বরাবর ব্রিটিশদের ঘৃ’ণা করেছি, ভারতীয় বাঙালিদের জন্য এটা খুবই লজিক্যাল! অন্যদিকে ছোটো থেকে আমেরিকার মোড়ল’গিরি দেখতে দেখতে ওদের হে’ট করাটাও স্বাভাবিক।
অন্যদিকে, জাপান আমার খুবই প্রিয় দেশ। জাপানিজ কালচার, ওদের জীবনবোধ, আইডিয়োলোজি, আমাকে বরাবরই টানে! তাই, বিশ্ব’যুদ্ধে আমি অক্ষশক্তির দিকে কিছুটা ঝুঁকে ছিলাম। তবে জার্মানদের নিয়ে আমি বরাবর সন্দিহান থাকতাম! হিটলারকে আমার খুবই পিকু’লিয়ার ক্যারেক্টার মনে হতো। আমার খুব কাছের বন্ধু আবার হিটলারের অন্ধ ভক্ত ছিল, এখন আছে কিনা জানি না! সেটাও আবার একটা প্রভাবক ছিল। অন্যদিকে, জাপানে মা’রা দুটো পারমাণবিক বো’মা তো অবশ্যই জাপানকে সিম্প্যাথি গেইন করতে হেল্প করছিল।
#আরও পড়ুন » বিবর্তন
যাই হোক, মূল কাহিনি আসলে বিশ্ব’যুদ্ধ নিয়ে না! বিশ্ব’যুদ্ধের কাহিনি টানছি, প্রেক্ষাপট বুঝাতে। বিশ্ব’যুদ্ধের আসল ইতিহাস ইন ডিটেইলস জানার পর, আমার ২৫ বছরের বিশ্বাস – চিন্তা ভাবনা অনেক বদলে গেছে! সব হিসেব-নিকেষ উলটে গেছে। এখন আর অক্ষশক্তির জন্য সিম্প্যাথি কাজ করে না।
পৃথিবীটা ভালোবাসার হোক
এবার মূল কাহিনিতে আসি! ছোটোবেলায় নিজেদের যু’দ্ধের ঝাপসা ইতিহাস, বিশ্ব’যুদ্ধের ঝাপসা ইতিহাস, তখন ইরাকে চলা আমেরিকার আগ্রা’সন; এগুলো দেখে দেখে আমার ব্রেইনওয়াশড চাইন্ড মাইন্ডে তীব্র জাতীয়তাবাদ বাসা বেঁধেছিল। আমার মাথায় কেন জানি ঢুকেছিল, এই বুঝি ইরাকের মতো আমেরিকা এসে বাংলাদেশে আগ্রা’সান চালাতে শুরু করবে, আমেরিকা না আসলেও ইন্ডিয়া আসবে, ইন্ডিয়া না আসলেও চীন আসবে। কেউ তো আসবে। আমাকে একলা হাতে হলেও দাঁড়ায় যেতে হবে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র বাঁচাতে। সারাদুনিয়া গো’ল্লায় যাক! বাংলাদেশের বুকে কোনো আঁচ লাগতে দেওয়া যাবে না!
ছোটোবেলায় যখন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে, ঠিক করেছিলাম, বিজ্ঞানী হব। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু বায়োলজি, কেন জানি আমাকে টানতো না! আমারে সবসময় ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিই টানতো। তো, ওই যে ছোটোবেলার আইডিয়োলজি, সেখান থেকে আমি বসে বসে দিবাস্বপ্ন দেখতাম। আমার কিছু বন্ধুও আমার দিবাস্বপ্নের পার্টনার ছিল।
আমাদের দিবাস্বপ্ন ছিল এমন
বাংলাদেশকে যেমনে হোক, পারমাণবিক অ’স্ত্র দিয়ে, বিশ্বের মোস্ট সুপার পাওয়ার দেশ বানাতে হবে। বাংলাদেশে ইউরেনিয়ামের খনি নেই। তাই ইউরেনিয়াম অন্য দেশের খনি থেকে হাই-টেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চু’রি করে নিয়ে আসবো। এর জন্য স্কুলে বসে টাইম মেশিন বানাতে, আমরা প্রচুর পড়াশোনা আর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগে, টাইম মেশিন আরও অবাস্তব জিনিস ছিল! এই সত্য বুঝার পর, টাইম মেশিন আর ইউরেনিয়াম চু’রি করার চিন্তা বাদ দিয়ে, এবার লাগলাম— কেমিস্ট হব। অন্য কোনো মৌল থেকে প্রোটন বের করে ফেলে, কিংবা এক্সট্রা প্রোটন অ্যাড করে ইউরেনিয়াম বানাব। এই বুদ্ধি মেবি, জাফর ইকবাল স্যার নাকি অন্য কোন লেখকের একটা সাই-ফাই বই থেকে পেয়েছিলাম। ওই গল্পের নায়ক, মার্কারি / পারদ [৮০] থেকে ১টা প্রোটন আউট করে, স্বর্ণ [৭৯] বানিয়ে বেচে বেচে বড়োলোক হয়ে যায় মেবি! এই আইডিয়া থেকে আরকি!
#আরও পড়ুন » যে কুয়াশা, সকাল এনেছিল!
[যারা ইউরেনিয়ামের কাহিনি বুঝছেন না, তাদের জ্ঞাতার্থে- ইউরেনিয়াম হলো পারমাণবিক বো’মা বানানোর মূল কাঁচামাল!]
এর সাথে আরও ভেবেছি, মোবাইল নেটওয়ার্ক যেমনে কাজ করে, ওইভাবে বাংলাদেশকে সিকিউর নেটওয়ার্কে রেখে, বাকিসব দেশ বো’মা / মিসা’ইল মেরে উ’ড়ায় দেবো। লাইক— বর্ডারের কয়েক ইঞ্চি ওপাশে গেলে দেশি সিমের মোবাইল নেটওয়ার্ক আর কাজ করে না। এই সিস্টেমে, পুরো বাংলাদেশের মানচিত্র সেইফ নেটওয়ার্ক সিস্টেমে নিয়ে আসবো। এরপর আশেপাশের বাকিসব দেশ উ’ড়ায় দেবো। ইভেন, আমার এমনও চিন্তা ছিল, ওরা আমাদের অ্যা’টাক করলে, ডিফেন্স করতে মা’রব এমন না, আমরা হিটলারের মতো আমাদের সীমানা আরও এক্সপ্লান্ড করতে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে অ্যা’টাক করতে থাকব।
বাংলাদেশে প্রপার লোকেরাই, প্রপার ফ্যাসিলিটি পায় না, বড়ো বড়ো ভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় ল্যাব, প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট পায় না! সেখানে, স্কুল পড়ুয়া আমি-আমরা কোন বাল’ছাল! ফলে, আমাদের সেই কিশোর বয়সী সাই-ফাই দিবাস্বপ্ন, দিবাস্বপ্নই রয়ে গেল।
কিন্তু কলেজে উঠে, আমার আইডিয়োলজিতে বেশ বড়ো বড়ো আ’ঘাত পড়ল। কলেজে উঠে আমার আউট বই পড়া প্রচুর বেড়ে গেছিল। যত পড়েছি, পৃথিবীকে নতুনভাবে জেনেছি, নতুন চোখে দেখেছি, আমার ওয়াশড ব্রেইনের জট আস্তে আস্তে খুলেছে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে; সবকিছুকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে, বুঝতে শিখে গেছি।
এরপর একসময় ম্যাথ-ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পছন্দ করা আমি, বায়োলজির প্রেমে পড়লাম। এতে অবশ্য, তখনকার আমাদের বায়োলজির স্যারদের বেশ ভূমিকা ছিল। কলেজ শেষে, ভার্সিটিতে এসে বায়োলজিতেই রইলাম। মেডিকেলে পড়া হয়নি / পড়িনি [আমারে কেন জানি বাংলাদেশের মেডিকেল সিস্টেম টানে না], তবে মেডিকেল রিলেটেড সাবজেক্টে পড়েছি; যদিও সাবজেক্টের নামের শেষ ইঞ্জিনিয়ারিং থাকায় অনেকে ভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং, বাট এই সাবজেক্টের সাথে গতানুগতিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোনো সম্পর্ক নেই।
যাই হোক, ১২-১৫ বছর পর এসে, এখন আমার আইডিয়োলজি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আমার মাঝে আর উগ্র জাতীয়বাদ নেই। এখন আর আমি মানচিত্রে বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি বর্ডারলেস এক দেশ, এক পৃথিবীতে; যেখানে সবাই হিংসা, হানাহানি-বিদ্বেষ ছাড়া বসবাস করবে, সবাই সবাইকে ভালোবাসবে, সবাই সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। এখন আমি আর বলি না, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি, আমার মা! বলি যে— পৃথিবীই আমার মাতৃভূমি; মাদার আর্থ ইজ মাই মাদার! এখন আমি জানি, পারমাণবিক বোমা, মিসাইল, এয়ার স্ট্রাইক দিয়ে মুহূর্তেই ১ কোটি মানুষ মে’রে ফেলার চেয়ে, কোনো ন্যাচারাল ক্রাইসিস কিংবা হিউম্যানমেড ক্রাইসিস থেকে ১ জন মানুষকে বাঁচাতে পারাও অনেক কষ্টের, অনেক ক্রেডিটের কাজ!
#আরও পড়ুন » শীতকাল কি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে?
এখন আমি আর দিবাস্বপ্ন দেখি না, সব দেশকে উ’ড়ায় দিয়ে বাংলাদেশকে সুপার পাওয়ার বানাবো। স্বপ্ন দেখি যে— ম’রে যাবার আগে আমার অ্যাকাডেমিক ও টেকনিক্যাল নলেজ দিয়ে, পুরো পৃথিবীর হিউম্যান বিয়িংয়ের জন্য কোনো কাজ করে যাব, তাদের বাঁচাতে কিংবা তাদের লাইফকে আরেকটু ইজি করতে। এমন কোনো ভালো কাজ যেন করে যেতে পারি, যাতে আগামী প্রজন্ম আমাকে মনে রাখে শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায়।
পৃথিবীটা ভালোবাসার হোক, ভালোবাসাময় হোক…!