বহু পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজিগুলোর অন্যতম উদাহরণ হলো মিষ্টি আলু বা রাঙা আলু। বাঙালির বিভিন্ন প্রাচীন রান্না এই রাঙা বা মিষ্টি আলু ছাড়া অসম্পূর্ণ। পুষ্টিগুণ ও সুমিষ্ট স্বাদের জন্য মিষ্টি আলু বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু, আমরা অনেকেই জানি না, এর নানা উপকারিতা সম্পর্কে। তাই আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব— মিষ্টি আলুর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত। চলুন শুরু করা যাক।
মিষ্টি আলুর উপকারিতা ও অপকারিতা
মিষ্টি আলু:
মিষ্টি আলু বা রাঙা আলুকে ইংরেজিতে বলা হয় Sweet Potato এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম ইপোমিয়া বাতাতাস বা Ipomoea batatas। মিষ্টি আলু মূলত Convolvulaceae পরিবারের Ipomoea গণের একটি উদ্ভিদ, যা লতানো বীরুৎ জাতীয়। এর ফুল কিছুটা মাইকের মতো দেখতে, যার ভেতর দিকে বেগুনি ও বাইরে সাদা। মিষ্টি আলু এই লতানো গাছের গোড়ায় হয়, অর্থাৎ মিষ্টি আলু একটি মূল জাতীয় সবজি। এটি বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে, যেমন: সাদা, বেগুনি, লাল, খয়েরি, কমলা, হলুদ, ইত্যাদি।
মিষ্টি আলু বা রাঙা আলু গাছ অতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না, তাই শীতপ্রধান দেশে এই সবজি চাষ করা কঠিন। এটি একটি নাতিশীতোষ্ণ উদ্ভিদ। তাই মিষ্টি আলু বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে খুব ভালো জন্মে।
মিষ্টি আলুর ব্যবহারবিধি:
মিষ্টি বা রাঙা আলু বিভিন্ন ভাবে রন্ধনশিল্পে ব্যবহৃত হয়। এটি কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়, আবার পুঁড়িয়ে বা সেদ্ধ করেও খাওয়া যায়। বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় রান্না শুক্তোতে এর ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এটি সবজি হিসেবে রান্না করা হয়ে থাকে। আবার, মিষ্টি আলু দিয়ে বিভিন্ন মিষ্টি ও ডেজার্ট আইটেম তৈরি করা হয়ে থাকে। এছাড়াও স্টু ও স্যুপ হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে। এর নানাবিধ ব্যবহারের জন্য মিষ্টি আলু গণচীন, পাপুয়া নিউগিনি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রধান খাদ্য।
#আরও পড়ুন » মশাবাহিত ছয়টি ভয়ংকর রোগ!
মিষ্টি আলুর পুষ্টি উপাদান:
বহু পুষ্টি উপাদানে ভরপুর মিষ্টি আলু। সাধারণত সাদা রংয়ের মিষ্টি আলুর চেয়ে রঙিন (লাল, হলুদ, বেগুনি, ইত্যাদি) মিষ্টি আলুতে অধিক পুষ্টি উপাদান থাকে। বলা হয়ে থাকে, একটি মিষ্টি আলুতে প্রায় ১০০ ক্যালরি থাকে। এছাড়াও এতে ২ গ্রাম প্রোটিন, ২২ গ্রাম শ্বেতসার, ৩ গ্রাম আঁশ, ০ গ্রাম চর্বি রয়েছে। এমনকি একটি মিষ্টি আলু থেকে দৈনিক চাহিদার ২৬০ ভাগ ভিটামিনই পাওয়া যায়, যেমন— ১২.৬ ভাগ ভিটামিন বি৬, ২৮ ভাগ ভিটামিন সি। কেবল ভিটামিন নয়, রয়েছে বিভিন্ন খনিজও উপাদান, যেমন: লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, সোডিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ইত্যাদি।
মিষ্টি আলুর উপকারিতা:
ওপরেই জানলাম, মিষ্টি আলু বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। যা আমাদের শরীরের নানা উপকার করে। তাই এই পর্যায়ে মিষ্টি আলুর বেশ কিছু উপকারিতা সম্পর্কে জানবো।
১| দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে:
মিষ্টি আলু আমাদের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। কারণ মিষ্টি আলুতে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ। আমরা জানি, বিটা ক্যারোটিন সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের চোখকে রক্ষা করে। তাই চোখ ভালো রাখতে নিয়মিত মিষ্টি আলু খেতে পারেন।
২| রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে:
কলার চেয়েও অধিক পটাসিয়াম পাওয়া যায় এই মিষ্টি আলুতে। তাই, মিষ্টি আলু খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৩| ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:
মিষ্টি শব্দটা শুনেই অনেকে ডায়াবেটিস রোগী মিষ্টি আলু খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। জানলে অবাক হবেন যে, এই মিষ্টি আলু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও বেশ সহায়ক। কারণ মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। এছাড়াও এতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে। মিষ্টি আলুর স্টার্চি কার্বোহাইড্রেট আমাদের রক্ত প্রবাহে সুগারের মাত্রাও ধীর করে দেয়। তাই মিষ্টি আলু খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ থাকে। এমনকি আমেরিকান ডায়াবেটিস সোসাইটি এই মিষ্টি আলুকে ডায়াবেটিসের জন্য এক ধরনের সুপার ফুড বলে আখ্যা দিয়েছে।
৪| হজমে সহায়তা করে:
আমাদের অনেকেরই খাবার হজমে সমস্যা হয়। এই মিষ্টি আলু খেলে হজমে সমস্যা দূর হয়। কারণ মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর মিনারেল ও ভিটামিন বি, যা পেট ফাঁপা, গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তাই, যারা হজম সমস্যায় ভুগছেন তারা মিষ্টি আলু খেতে পারেন।
৫| রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
মিষ্টি আলু আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও বেশ কার্যকর। মিষ্টি বা রাঙা আলুতে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান এবং বিভিন্ন ভিটামিন (এ, বি, সি, ডি ও কে), যা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান হিসেবে আমাদের শরীরে কাজ করে। এছাড়া আমাদের শরীরের একাধিক সমস্যা দূর করে, আমাদের শরীর সুস্থ রাখে।
৬| শরীরের ক্ষয় রোধ করে:
মিষ্টি আলুতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টস এবং ক্যারটিনয়ডস নামক একটি উপাদান, যা আমাদের কোষের ক্ষয় রোধ করে।
৭| দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে:
মিষ্টি আলুতে প্রচুর ভিটামিন সি ও ডি রয়েছে। ভিটামিন সি আমাদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা দূর করে এবং ভিটামিন ডি হাড়, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, ত্বক ও দাঁত ভালো রাখে।
৮| হৃদযন্ত্র ভালো রাখে:
হৃৎপিণ্ড আমাদের শরীরের গুরত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটিতে কোনো সমস্যা হলে, আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন। আর এই হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতেও মিষ্টি বা রাঙা আলুর জুড়ি মেলা ভার। মিষ্টি আলু বা রাঙা আলু ভিটামিন বি৬-এর একটি ভালো উৎস। এই ভিটামিন বি৬ আমাদের শরীরে হোমোসাইস্টিন নামক এক ধরনের কেমিক্যাল কমায়, উল্লেখ্য এই কেমিক্যাল হৃদরোগসহ নানা ধরনের অসুখের অন্যতম কারণ। এছাড়াও মিষ্টি আলুতে থাকা পটাশিয়াম হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক রাখে।
৯| ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:
মিষ্টি আলুতে থাকা বিটা ক্যারোটিন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। যেমন: কোলন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, ইত্যাদি।
১০| দুশ্চিন্তা কমাতে সহায়তা করে:
মিষ্টি আলুতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, যা আমাদের দুশ্চিন্তা কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও এই ম্যাগনেসিয়াম স্বাস্থ্যকর রক্ত, হাড়, হার্ট, পেশি এবং নার্ভ গঠনে সহায়তা করে।
১১| ত্বক ও চুল ভালো রাখে:
মিষ্টি আলুতে থাকা ভিটামিন ই ও সি আমাদের ত্বক ও চুল ভালো রাখতে সহায়তা করে। এটি ত্বককে আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে, যার জন্য র্যাশ, ত্বক কালো হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আর ভিটামিন ই চুল পড়া রোধ করে ও চুলে পুষ্টি জোগায়।
১২| ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখে:
মিষ্টি আলুতে চর্বি থাকে না, রয়েছে প্রচুর ফাইবার। যা আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক।
#আরও পড়ুন » mRNA ভ্যাকসিন : HIV এর বিরুদ্ধে অ্যানিমল ট্রায়ালে সফল!
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ মিষ্টি আলুর নানাবিধ উপকারিতা সম্পর্কে জানলাম, এইবার এত পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টি আলুর বেশ কিছু অপকারিতা নিয়ে আলোচনা করব।
মিষ্টি আলুর অপকারিতা:
মিষ্টি আলুতে এত এত উপকারী উপাদান থাকার পরও, যদি এটি মাত্রারিক্ত খাওয়া হয় তবে তা বিপদ বয়ে আনে। চলুন জেনে নিই, তেমন কিছু বিপদ সম্পর্কে!
১| অতিরিক্ত মিষ্টি আলু খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। কারণ এতে অক্সালেট বেশি থাকে, যা এক ধরনের জৈব অ্যাসিড। তাই অধিক পরিমাণে মিষ্টি আলু খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে।
২| মিষ্টি আলুতে পটাসিয়াম রয়েছে। তাই অতিরিক্ত মিষ্টি আলু খেলে শরীরে পটাসিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়ে হার্টের সমস্যা হতে পারে।
৩| একটু আগেই জেনেছি, ডায়াবেটিস রোগীরা মিষ্টি আলু খেলে উপকার পাবে। কিন্তু, যদি পরিমাণের চেয়ে বেশি খাওয়া হয়, তবে বিপদ ডেকে আনতে পারে। যেহেতু এতে প্রাকৃতিক শর্করা রয়েছে।
৪| মিষ্টি আলুতে থাকা ম্যানিটোল (এক ধরনের কার্বহাইড্রেট) আমাদের শরীরের জন্য ভালো, তা যেমন সত্য। তেমনি অতিরিক্ত মিষ্টি আলু খেলে এই ম্যানিটোল পেটের সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
৫| এছাড়াও মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন রয়েছে। তাই অতিরিক্ত মিষ্টি আলু খেলে আমাদের শরীরে ভিটামিনের মাত্রা বেড়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটাতে পারে। যেমন: চুল পড়া বৃদ্ধি, ত্বকের ক্ষতি, ইত্যাদি।
তাই, মিষ্টি আলু পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত। এছাড়াও যাদের মিষ্টি আলুতে অ্যালার্জি রয়েছে তাদের মিষ্টি আলু এড়িয়ে চলা উত্তম। কেবল মিষ্টি আলু নয়, যেকোনো খাবার একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করা উচিত।
*****
যাই হোক, আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। আশাকরি, এই ‘মিষ্টি আলুর উপকারিতা ও অপকারিতা’ সম্পর্কিত আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। যদি ভালো লেগে থাকে, তবে নিজের পরিচিত জনদের সাথে শেয়ার করবেন এবং এই ধরনের আর্টিকেল পেতে আমাদের ব্লগে যুক্ত থাকুন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।